দুইদিন ধরেই মাথা পুরা আউলা।মিড এক্সামও দুই দিন ধরেই জ্বালাতন শুরু করেছে।গণিত না জানা পাবলিকেরও দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে সমস্যা হবার কথা না।আমার রুমমেট এরও একই রকম ধারণা।শুধু ধারণা করেই ক্ষ্যান্ত দেবার মানুষ ও নয়।দিনে পাঁচ বেলা নামায পড়ার মত নিয়ম করে আমাকে সেটা শুনিয়েও যাচ্ছে বার বার।পুরো সেমিস্টার ফাঁকি দিয়ে এক্সাম এর আগে মাথা তো আউলা হবেই কিংবা ভার্সিটির পাশের ওয়ার্কশপের মিস্তিরির GPA টাও আমার চে ভাল- এই টাইপ কথা হরদমই আমাকে শুনতে হয়।আমি তেমন গা করিনা।দুইদিন ধরে মাথা আউলা বলে আরো করছিনা। ইদানীং ব্লগেও কেমন জানি মেঘ জমে থাকে।ঘরের নতুন অতিথি দের লেখা "মন খারাপের দিনগুলি","না বলা কথা" কিংবা ধুসর গোধূলি গুরুর "গুরুচন্ডালি" দুঃখ কথন অথবা অনিকেত ভাইয়ের "মন্তব্যের মন্তাজ"- এসব পড়ে মনে হয় সবাই জামাতের (জামায়াতে ইসলামি ভাইবেন না আবার) সাথে দুঃখবিলাসী হবার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।সুলতানা পারভীন শিমুল আপুর লেখাগুলোও আমি পারলে চোখ বন্ধ করে পড়ি।এত সুন্দর করে তিনি গল্পের পুরো শরীর জুড়ে দুঃখগুলো ছড়িয়ে দেন যে শেষ পর্যন্ত সেগুলো না কুড়িয়ে থাকতে পারিনা।গল্প পড়া শেষেও অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকি।চরিত্রগুলোকে আশেপাশের কেউ ভেবে ভুল হয়।দুহাত ভরে দুঃখ নিতে তারপরেও সচলায়তন খুলে বসে থাকি আউলা মাথা নিয়ে... ......... আজ অডিটোরিয়ামে বসে পরীক্ষা দিচ্ছি।প্রশ্ন মনে হয় খুব বেশি কঠিন হয়নি।কিন্তু আমার প্রস্তুতির গুনে সেটা কঠিন এর চেয়ে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কিছু কম মনে হচ্ছেনা।বেকুবের মত শুকনা মুখ করে বসে আছি।স্যারও এসে একবার দেখে গেছেন।এমন অবস্থায় মোটামুটি ভদ্রস্থ একটা জিপিএ উঠাতে কত লাগে ক্যালকুলেটর খুলে সেটাই হিসেব করার কথা।কিন্তু হঠাৎ আমি হেসে উঠলাম।এমন আকস্মিক হাসির ফল হল দুটো।পাশে বসা রুপাইয়ের চেয়েও কুটকুটে কালো দর্শন আফ্রিকানটা ঘাড় বেঁকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো যে কাহিনী আসলে কি হইলো।মোটা মাথায় কিছু বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ কটমট করে তাকিয়ে রইলো।তারপর আবার নিজের লেখায় মন দিলো।এদিকে সামনে তাকিয়ে দেখি গোফ অলা মাস্টারটাও রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি তেমন একটা পাত্তা দেইনা।বাইরে টাঙিয়ে দেয়া এক্সাম হলের রুলস এন্ড রেগুলেশনের কোথাও লেখা নেই এক্সাম হলে হাসা যাবেনা।আমার মিটিমিটি হাসি দেখে সারাক্ষণ পেঁচার মত মুখ করে রাখা স্যারের মুখটা বিরক্তিতে আরেকটু কুঁচকে উঠে।আমার হঠাৎ এমন হাসির কারণ আর কিছুই না।কালকে পড়া অলৌকিক হাসানের "কুয়াশাখ্যান" এর শেষ ছবির ক্যাপশনটা মনে পড়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে- "এখন ঘাড়ে উঠছে,কয়েকদিন পরে মাথায় উঠবে" ......... আই ইউ টি তে থাকতে ফাহিম ভাইকে (কিংকর্তব্যবিমূঢ়) চিনতাম।কিন্তু কখনোই সেভাবে কথা হয়নি।সচলায়তনে এসেই কমেন্টে প্রথম বাতচিত।ফাহিম ভাইয়ের লেখার আমি বরাবরই ভক্ত।এত মজা করে মানুষ ক্যামনে লেখে কে জানে।লাস্ট দুইটা পর্বে ক্যামন জানি মন খারাপ আর টেনশনের আভাস পাই।এমন টাইপের লেখাগুলা দুঃখী দুঃখী ভাব করে শুকনা মুখে পড়ার নিয়ম।কিন্তু কেন যেন পারিনা।উনার লেখা দেখলেই মুখটা হাসি হাসি হয়ে যায়।এমনকি যখন ইনিয়ে বিনিয়ে নেক্সট সপ্তাহে এক্সামে মহা দুর্যোগ কিংবা সামনে আর্থিক কষ্টের কথা বলেন তখনো পেট ফেটে হাসি আসে।এমন ভাবে লিখেন যে মনে হয় আর্থিক সমস্যায় পড়ার চে মজার ব্যাপার দুনিয়ায় খুব বেশি পয়দা হয়নি।তারপরেও হাসিটুকু মুছে যাবার পর দ্বিতীয়বার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি।আহারে বেচারা না জানি ক্যামনে কি করতেসে... ...... মহিব(পরিবর্তনশীল) এর সাথে আমার পরিচয় আই ইউ টি তে আসার কিছু দিন আগে।এইচ এস সি র পর যখন ভর্তি কোচিং করছিলাম তখন প্রথম আলাপ।আই ইউ টি তে এসে সেদিনকার সেই পরিচয় ছাপিয়ে কখন আমরা ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছি বুঝতেই পারিনি।একই কথা রায়হানের (রায়হান আবীর) বেলায়ও খাটে।আর মুহাম্মদ তো(শিক্ষানবিস) আমার কলেজমেট।একসাথে থাকতে থাকতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বন্ধুত্বের হাত ধরে অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি।সেই রেশ ধরেই ভাবতাম আমি ওদেরকে খুব ভাল মত চিনি।কিন্তু সে ভাবনায় ভুল ছিল।ভুলটা ভাঙ্গালো সচলায়তন,এখানে এসে ওদেরকে আবার নতুন করে চিনলাম।মহিবের লেখাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় এরকম একটা "জিনিস" পাশে নিয়ে এতদিন ধরে ঘুরি অথচ কোনদিন টেরও পেলাম না।আবার রায়হান যখন ওর ছোট বেলায় হারিয়ে যাওয়া আপু সোনাটার কথা ভেবে কলম ধরে তখন ভাবি এত হাসি খুশি চেহারার ছেলেটা বুকের মধ্যে এত দুঃখ জমিয়ে রেখেছে আগে তো কখনো বুঝিনি।আর মুহাম্মদ যখন সচলায়তনে সহজ সরল গদ্যে সাধারণ আপেক্ষিকতার ক্লাস নেয় কলেজের ফিজিক্স স্যারের কোনঠাসা মুখটার কথা মনে পড়ে।এই "নরমাল" ব্যাপারটা বুঝাতে গিয়েই বেচারা কি ঝামেলায়ই না পড়সিলো।এতসব কিছু ভাবতে ভাবতেই ওদেরকে পাশে নিয়ে একসাথে পথ চলি।কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা এই বন্ধুগুলোর ছায়া ইদানিং আগের চে যেন আরো একটু দীর্ঘ মনে হয়... ...... সচলায়তনের সাথে পরিচয়ের পর থেকেই আমার জীবন অনেকটাই বদলে গেছে।আগে ল্যাব ক্লাস শেষে একঘেয়ে বিষণ্ন বিকেলগুলোতে পুরোনো দিনের কথা ভেবে আরো একটু বিষণ্ন হতাম।এখন আর তেমন করে বিষণ্ন হয়ে ওঠা হয়না।কানাডার নোভাস্কশিয়া থেকে জার্মানির কাসেল কিংবা ভুট্টাক্ষেতের কোল ছুয়ে ভুতের গলির মোড় আমার অন্ধকার রুমে এসে সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।মনিটরের কাঁপা কাঁপা আলোয় হিমু,জেবতিক আরিফ,অমিত আহমেদ,আনোয়ার সাদাত শিমুল,মুহাম্মদ যুবায়ের,দ্রোহী...... আরো কত শত নাম দেখে মনেই হয়না এদের কাউকেই আমি চিনিনা।কনফুসিয়াস-নিঘাত তিথির রুপকথার মত ডালিমকুমার আখ্যান পড়ে স্বপ্নাহত আমার মন কিছুক্ষণের জন্য অন্য কোন তিথিকে হারানোর দুঃখ বেমালুম ভুলে থাকে।কিংবা ধূসর গোধূলী গুরুর "সেইরকম" সব কমেন্টস পড়ে আউলা মাথা,আউলা মন সব ঠিক হয়ে যায়।খুব অল্প দিনের মধ্যেই সচলায়তন এত সব অচেনা মানুষগুলোকে কেমন চিনিয়ে দিল।আবার চেনা বন্ধুগুলোকেও অচেনা আলোয় নতুন করে খুঁজে পেলাম।বুঝতেই পারলাম না ভার্চুয়াল জীবনের দেয়াল ভেঙ্গে সচলায়তন কখন কেমন করে আমার আউলা জীবনে এসে মিশে গেল। ...... কালকেও একটা ঘাড় ত্যাড়া এক্সাম আছে।এই লেখাটা লেখার কথা ছিল উইকেন্ড এ,এক্সাম এর ঝামেলা সামলে।বই খোলার বদলে তবু সচলায়তন খুলে বসে আছি।যদি আমার রুমমেট এর মত আপনিও ভাবেন এটা আউলা মাথার বাউলা পোস্ট তাহলে জেনে রাখুন নিশ্চিতভাবেই আপনি ভুল করছেন। আসলে এ ব্যাপারে আমার আর কিচ্ছু করার নাই।ব্যাপারটা আর হাতে নাই...কারণ?